গোড়ার কথা
ইন্টেরিয়র ডিজাইন শব্দটা শুনলে মনে হয় এই বুঝি সেদিন থেকে শুরু। আর অবধারিতভাবে এও নিশ্চয়ই পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করা বিদ্যা। বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, ইউরোপ আমেরিকার লোকেরা যখন নেংটি পরে বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, তখন থেকেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনের চর্চা হতো ভারতবর্ষে! তখন এর নাম ছিল বাস্তুশাস্ত্র। এক দুই বা চার পাঁচশ বছর আগের কথা নয়, গুনে গুনে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা বলছি! তখন এই বাস্তুশাস্ত্র ভারত থেকে রফতানি হয়েছিল চীনেও। চীনারা আবার কী-না পারে। তারা এই বাস্তু শাস্ত্রের সঙ্গে এক চামচ বিজ্ঞান আর দুই টেবিল চামচ আধ্যাত্মবাদ মিশিয়ে ঘুটা দিয়ে বানালো আরেক নতুন বস্তু। নাম দিল ফেং শুই। ঘর বাড়ি বানানো থেকে সাজানো পর্যন্ত সবকিছুতেই টিপস আছে ফেং শুইয়ের। তবে ওসব মানা না মানা একান্তই যার যার নিজস্ব বিষয়।
ফেং মানে বাতাস আর শুই মানে পানি। এই বাতাস-পানির সাথে ঘর বাড়ির নকশার কী সম্পর্ক? ব্যাখ্যাটা সংক্ষেপে সেরে নেয়া যাক। চীন ও ভারতীয় সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস পৃথিবীর একটা নিজস্ব শক্তি আছে। যে শক্তি এ গ্রহটার ওপর দিয়ে বয়ে বেড়ায়। সম্ভবত কোনওভাবে ওই সন্ন্যাসীরা পৃথিবীর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শক্তির বিষয়টা জানতেন! সে যাক, এই শক্তিবলয়ের একটা নিজস্ব গতি আছে। সেই গতিতে বাধা পড়লেই বিপত্তি। জীবনে নেমে আসে অশান্তি ও ব্যর্থতা। এই শক্তি প্রবাহে যেন বাধা না আসে, এদিকটা খেয়াল করে বানাতে হবে ঘরবাড়ি, উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট আর গোটা শহরের নকশা। শক্তিবলয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাজাতে হবে ঘরের ভেতরটাকেও। সংক্ষেপে এটাই ফেং শুই। আর হ্যাঁ, চীনারা বরাবরই বাতাস ও পানিকে শান্তি ও সাফল্যের প্রতীক হিসেবে দেখে আসছে। নামকরণটা সেখান থেকেই। নাম আর পরিচয়পর্ব অনেক হলো। ফেং শুই নিয়ে আছে বিস্তর পাঠ্যবইও। নগর নকশা আর রাস্তা ঘাট কোন দিকে হলে ভাল হবে ও নিয়ে আপাতত মাথা না ঘামানোই উত্তম। আমরা দেখে নেই, অন্দরমহলের নকশায় বাস্তুশাস্ত্র ওরফে ফেং শুই কী বলে।
রান্নাঘর
শুধু চীনারা নয়, প্রায় সবার কাছেই রান্নাঘরটা হলো ঘরের প্রাণ। আর ইন্টেরিয়রে ফেং শুই শুরুই হয় এখান থেকে। প্রথম পাঠেই বলা হয়েছে, ওভেন/চুলা, রেফ্রিজারেটর আর সিংকের অবস্থান এমন হতে হবে, যাতে করে তিনটি বিন্দুকে যোগ করে একটি সমবাহু ত্রিভুজ দাঁড়ায়। ভেতরের বুজরুকি যাই থাকুক, পদ্ধতিটা নান্দনিকতার খাতিরে যুৎসই বটে।
রান্নাঘরে হলুদ, লাল বা সাদার মতো উজ্জ্বল রঙের কথা বলা হয়েছে ফেং শুইতে। হলুদ রঙটা নাকি হজমের জন্য ভাল। এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে নীল ও কালো।
পরিচ্ছন্নতায় কম জোর দেয়নি এই ফেং শুই। বাস্তুশাস্ত্র এক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দিয়েছে, রান্নাঘরে অন্তত যেন চোখের আড়ালে কিছু না থাকে। এতে পৃথিবীর শক্তির কী যায় আসে তা কেউ না জানলেও নিজের শক্তির যে অপচয় কম হবে তা নিশ্চিত। রান্নাঘরের টেবিলে সবসময় এক বাটি ফল বা ফুলদানি সাজিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ফেং শুই মোতাবেক এতে করে খাবারের প্রতি এক ধরনের আত্মার সম্পর্ক তৈরি হবে। শরীরের জন্য যাহা মহা উপকারী!
অফিস
অফিসে কাজ করার সময় চোখের সামনে দরজা থাকা বাঞ্চনীয়। এতে কাজের সময় এক ধরনের আরামদায়ক অনুভূতি তৈরি হবে। (এই ফেং শুইয়ের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাটা কী হতে পারে? দরজা মানেই তো বের হওয়ার রাস্তা। আর বের হওয়ার রাস্তাটা সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকলে মন ভাল থাকাই স্বাভাবিক!)
শোবার ঘর
বেডরুম নিয়ে সবচেয়ে উপকারী টিপসটা হলো বেডরুম যতটা সম্ভব যন্ত্রপাতি মুক্ত রাখা। টিভি কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন দূরে থাকলেই মঙ্গল। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে এর। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে নির্গত তরঙ্গ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, আবার রেডিয়েশন বের হয় এমন যন্ত্র থাকলে মগজেও ক্ষতি হতে পারে। এখন কী আর ফেং শুইকে কুসংস্কার বলবেন? আর শোবার ঘরের সঙ্গে লাগানো বাথরুমের দরজা রাতে বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে করে এক ঘরের অন্তর্নিহীত শক্তি আরেক ঘরে বিঘœ ঘটাবে না।
দেয়ালের রঙ
দেয়ালের বাইরের দিকে তিনটির বেশি রং ব্যবহার না করার শিক্ষা দেয়া হয় ফেং শুই স্কুলে। মানবেন কি মানবেন না, সেটা আপনার বিষয়।
টেবিলের কোণা
শুনতে একটু অন্যরকম লাগবে, তবু বলি। টেবিল চেয়ারের কোণাগুলো বেশি চোখা না রাখার পরামর্শ দেয় ফেং শুই। কোণাগুলো যত ধারালো হবে, ততই নেতিবাচক শক্তি আপনার দিকে ধেয়ে আসবে। অবশ্য কোণাগুলো মসৃণ হলে আঘাতজনিত দুর্ঘটনার হাত থেকেও বাঁচবেন।
ভাঙাচোরা তাড়িয়ে দিন
ঘরের ভেতর ভাঙাচোরা অনেক কিছুই আমরা কোনও এক রহস্যজনক কারণে ফেলে দিতে চাই না। আর এ কাজে আলসেমী বা সময় না থাকাকেই এক নম্বর কারণ বলবে সবাই। বারবার ওই সব ভাঙাচোরার দিকে চোখ যায় আর বিরক্ত হই আমরা। এতে করে আমাদের মেজাজে দারুণ ঋণাত্মক শক্তিবলয় দেখা দেয়। সুতরাং ফেং শুইয়ের কথা শুনুন। ঝেড়েমুছে ফেলে দিন যাবতীয় অকেজো জিনিসপত্র। ছিমছাম শব্দটার মধ্যে একটা ধণাত্মক শক্তির ইঙ্গিত আছে না?
বাইরের আলো-বাতাস
ঘরের ভেতর বাইরের আলো-বাতাস বেশি করে ঢোকানোর ব্যবস্থা করলে আপনার হার্ট ভাল থাকবে। কারণ, বিদ্যুৎ বিল আসবে কম। অর ফেং শুই বলছে প্রাকৃতিক আলো বেশি ঢুকলে বাড়ির আত্মাও নাকি ভাল থাকে! ভয় পেয়ে আবার কপাট বন্ধ করে দেবেন না যেন। বাড়ির আত্মার সমৃদ্ধি মানে হলো বাড়ির ভেতর প্রকৃতি প্রদত্ত উপকারী উপাদানের সুষম সন্নিবেশ। আদৌ কিছু বোঝা গেল?
এখন কী ভাবছেন, ফেং শুই ঠিক ফেলনা কিছু নয়। অবশ্য ফেলনা হলে এ নিয়ে গোটা দুনিয়ায় এত এত কোচিং সেন্টার থাকতো না। ১৯৮০ সাল থেকে এ বিষয়টা নিয়ে আমেরিকাতেও ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। অনেক বড় বড় ঘরবাড়ির নকশা করা হয়েছে ফেং শুইয়ের গাণিতিক ফর্মুলা অনুযায়ী। সুতরাং ঘর সাজানোর আগে একবার হলেও ফেং শুইকে উল্টেপাল্টে দেখে নেয়াই যায়। বলা তো যায় না, ধনাত্মক শক্তির প্রভাবে আপনার বাড়িটা কোন দিন আবার গা দুলিয়ে হেসে ওঠে!
--ফয়সল আবদুল্লাহ
dhrubonil@yahoo.com
No comments:
Post a Comment