উৎসব মানেই নিজস্ব সংস্কৃতি
ও দেশের পরিচয় তুলে ধরার একটা আনন্দঘন মাধ্যম। কিন্তু কিছু উৎসব আছে যেগুলো দেশ ও সংস্কৃতির
গণ্ডি পেরিয়ে চলে যায় অন্য স্তরে। ঈদ তেমনই এক বৈশ্বিক উৎসব। যতই যুদ্ধ আর আন্দোলন
চলুক, চাঁদ দেখা গেলে একটি দিনের জন্য হলেও থেমে যায় যাবতীয় গোলযোগ আর সহিংসতা। এ উৎসবের
শক্তি এতটাই যে, এটি একবার হলেও সবার মনে শুনিয়ে দেবে সাম্য, শান্তি আর সমৃদ্ধির বিশুদ্ধ
সংগীত। আর ঈদের আনন্দ প্রকাশের ভাষাও সব দেশে এক। তবে কিছু ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য যে নেই,
তা নয়!
আফ্রিকা
উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশই
মুসলিমপ্রধান। এর মধ্যে ঈদের দিন উৎসবের আমেজে বেশি সাজতে দেখা যায় তিউনিশিয়া, মিসর,
সাউথ আফ্রিকা, সুদান ও নাইজেরিয়াকে। বরাবরের মতো এবারও তিউনিসদের দেখা যাবে বকলভা আর
কা’ক নামের দুটো খাবার
দিয়ে ঈদুল ফিতরের দিনটাকে মিষ্টি করে তুলতে। কা’ক নামের কেক জাতীয় খাবারটির
চেহারা দেশভেদে একেক রকম হয়। তিউনিশিয়ায় এটি দেখতে ডোনাটের মতোই। আংটির মতো দেখতে খাবারটির
ওপর তিল ছড়ানো থাকে। আবার লেবাননে এই কেকের মাঝে কোনো ফাঁক থাকে না। ঈদের নামাজ শেষে
মহল্লায় দলবেঁধে নাচ গান করতে থাকে সবাই। খানাপিনা চলতে থাকে দিনভর। এরপর আমাদের মতোই
শুরু হয় আত্মীয়ের বাসায় যাতায়াত।
তিউনিশিয়ায় ঈদের ছুটি দুদিন
হলেও মিসরে তা তিন দিন। অন্যান্য ঈদুল ফিতরে মিসরীয়রা তাদের ছড়ানো-ছিটানো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে
ভিড় জমালেও এবারের অবস্থা একটু ভিন্ন। বেশ কিছুদিনের টানা সহিংসতা ও রাজনৈতিক টানপড়েনে
মিসরীয়দের এবারের ঈদটা বলতে গেলে মাটিই হয়ে গেছে। এরপরও হয়ত অনেককেই রান্না করতে দেখা
যাবে ফাতা নামের মিসরীয় খাবার। ভেড়া আর রুটি দিয়ে বানানো হয় এ স্যুপ। এর বাইরে খাক
নিয়ে ঘুরতে দেখা যাবে দেশটির শিশুদের। বাদামে ভর্তি আর চিনির গুঁড়ো ছড়ানো এ বিস্কিটটিও
মিসরের ঈদ-ঐতিহ্যের বাধ্যতামূলক অনুষঙ্গ। শুধু বাংলাদেশ নয়, মিসরের টিভি চ্যানেলগুলোতেও
সপ্তাহব্যাপী ঈদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তবে অনুষ্ঠানের তালিকায় রাজত্ব করে সিনেমা আর
তারকাদের সাক্ষাৎকার।
এক মাস সিয়াম সাধনা করা
হয় বলে ঈদ উৎসবের একটা বড় অংশই জুড়ে আছে খাবার। আর এই দিনে সোমালীয়দের কাছে মজার খাবারের
আরেক নাম হালুয়া। প্রত্যেকের ঘরে আর কিছু না হোক, হালুয়া থাকবেই। সাউথ আফ্রিকায় উৎসবটা
শুরু হয়ে যায় চাঁদ দেখার পরপরই। শেষ রোজার দিন ইফতার সারতে রাজধানী কেপটাউনের গ্রিন
পয়েন্টে এসে জড়ো হতে থাকে সবাই। একসঙ্গেই সারা হয় ইফতার। চাঁদ দেখার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার
পর চলতে থাকে কুশলাদি বিনিময় পর্ব।
সুদানের ৯৭ ভাগ নাগরিক
মুসলমান। কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয় ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি। এখানেও মজার সব খাবারের
আধিপত্য। কা’ক ছাড়াও সুদানিদের বেশি
পছন্দ বিস্কিট জাতীয় খাবার বেটিফুর। কিশোরী ও তরুণীরা হাত ও পায়ে মেহেদি লাগায়। অবস্থাসম্পন্নরা
তাদের বাড়ির ভেতরে-বাইরে আঁকে আফ্রিকান ঘরানার আলপনা।
এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য
ভারত ও পাকিস্তানে ঈদুল
ফিতর উৎসবের রীতি অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। সেই মুঘল আমল থেকেই একই ধরনের মিষ্টান্ন
ও খাবার রান্না হয়ে আসছে ঈদের দিন। ঐতিহ্যটা আঁকড়ে ধরে রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে
সেমাই। ঈদের সময় আর কোনো দেশের মানুষকে সেমাই নিয়ে এতটা আবেগপ্রবণ হতে দেখা যায় না।
সৌদি আরবের ঈদের প্রাক্কালে
ভিন্নতা দেখা যায় কেনাকাটায়। প্রায় প্রতিটি দোকানেই রয়েছে ঈদের কেনাকাটার সঙ্গে বিশেষ
উপহার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পোশাকের সঙ্গে এক বাক্স ক্যান্ডি উপহার দিচ্ছে দোকানিরা।
আর হাতের কাছে যাকে পাবে তাকেই ঈদ মোবারক জানিয়ে কোলাকুলি করে দেশটির বাসিন্দারা। কোনো
আত্মীয়তা কিংবা পূর্বপরিচয় ছাড়াই দেখা যায় উপহার বিনিময় করতে। শিশুরাই অচেনা আগন্তুকের
কাছ থেকে এমন ঈদ উপহার পেয়ে থাকে।
তুরস্কে ঈদুল ফিতরের আরেক
নাম বয়রাম। কেউ বলে সেকের বয়রামি, মানে মিষ্টান্নের উৎসব। আবার রমজান বয়রামিও বলে থাকেন
অনেকে। এ সময় এক তুর্কি আরেক তুর্কিকে ‘বয়রামিনিজ মুবারক ওলসুন’ বলে স্বাগত জানায়। যার মানে
হলো আপনার বয়রামে মঙ্গল হোক। তবে বড়দের এ কথাটা শুধু মুখে বললেই হয় না। হাতের ডান হাতে
চুমু খেয়ে সেই হাতটা নিজের কপালে ধরে রেখে কথাটা বললে তবেই যথাযথ সম্মান দেখানো হয়।
রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে গিয়ে বয়রামের শুভেচ্ছা জানায় তুর্কি শিশুরা।
এমন শুভেচ্ছার বিনিময়ে চকোলেট কিংবা অল্পকিছু টাকা তাদের হাতে তুলে দেয়ার রেওয়াজও আছে
সেখানে। এছাড়া ঈদুল ফিতরের দিন দরিদ্রদের জন্য তহবিল সংগ্রহের আয়াজনও করতে দেখা যায়
নগর কর্তৃপক্ষকে।
সারাদিন বোমাতঙ্কে ভুগতে
থাকা আফগানরাও এদিন ভুলে যায় যাবতীয় শঙ্কা। একে অপরকে জানায় ‘কোচনাই আখতার’। পশতু ভাষায় এটাই হলো ‘ঈদ মুবারক’। ঈদের দশ দিন বাকি থাকতেই ঘরদোর সাফসুতরো করতে শুরু
করে আফগানরা। এই প্রক্রিয়াটারও একটা নাম আছে-খানা তাকানি। তারপর শুরু হয় ঈদের কেনাকাটা।
গতবারের মতো এবারের ঈদেও
হাসি ফুটবে না বেশিরভাগ সিরীয়র মুখে। ঈদের দিন হামলা বন্ধ রাখার সরকারি ঘোষণায় সম্ভবত
কারোরই মন ভরেনি। তবে যতটা সম্ভব হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছে দাতা সংস্থাগুলো। এরই মধ্যে
সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছে ‘ঈদ ইন সিরিয়া’ নামে
একটি ৭৫ লাখ ইউরোর ত্রাণ বহর। তবে পোশাক বা খাবার নয়, এই ঈদ উপহারে থাকছে ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স
ও অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র। আপাতত এগুলোই বেশি দরকার দেশটির।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের আনন্দের
একটা বড় উৎস হলো কেটুপাত নামের একটি খাবার। সঙ্গে আছে ওপোর আয়াম, রেনডাং, সাম্বাল গোরেং
আতি, সায়ুর লোদে ও লেমাং। বিশেষ কায়দায় পাম গাছের পাতার ভেতর চাল মুড়িয়ে পিঠার মতো
করে বানানো হয় কেটুপাত। স্বাদ যেমনই হোক, দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো এটি।
মালয়েশিয়া, ব্র“নাই ও সিঙ্গাপুরে
ঈদুল ফিতরের স্থানীয় নাম হারি রায়া আদিলফিতরি। হারি রায়ার অর্থ হলো উদযাপনের দিন। তবে
আগের দিন রাত থেকেই শুরু হয় আনন্দোৎযাপন। মালয়েশিয়ার মসজিদে মসজিদে চলতে থাকে সৃষ্টিকর্তার
বন্দনা ও তাকবির। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে বাড়ির বাইরে জ্বালানো হয় কুপি বাতি। একে অন্যকে
স্বাগত জানিয়ে বলে ‘মাফ জাহির দান বাতিন’। যার অর্থ, আমার শরীর ও মনের অপরাধগুলো ক্ষমা করবেন।
এ সময় জমকালো বাদ দিয়ে মালয়েশীয়দের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতেই দেখা যায়। আগে এ
উৎসবের দিন আতশবাজি পোড়ানোর রীতি থাকলেও এখন তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মায়ানমারের মুসলমানদের
আতঙ্ক এখনও কাটেনি। সাম্প্রতিক ধারাবাহিক দাঙ্গার পর এবারের ঈদ খুব একটা পরিবর্তন আনবে
বলেও মনে করছে না তারা। তা ছাড়া ঈদুল ফিতর দেশটিতে সরকারি ছুটির দিন নয়। দেশটির সংখ্যালঘু
মুসলমানদের নিজেদের মতো করে ছুটির ব্যবস্থা করতে এ দিন। দেশটির ধর্ম বিভাগও মুসলমানদের
এ দিন উৎসবের আমেজ তৈরিতে অনুৎসাহী করে। ঘর সাজানো, নাচ-গান, আলোকসজ্জা এমনকি ঈদ কার্ড
দিতেও তাদের বাধা পোহাতে হয়।
চীনে ১ কোটি ৮০ লাখ মুসলমান
আছে। শুধু নিংজিয়া ও জিংজিয়াং প্রদেশেই ঈদুল ফিতরের দিন সরকারি ছুটি থাকে। ইউনান প্রদেশে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলমানরা ঈদের নামাজ শেষে প্রদেশের প্রথম গভর্নর সাঈদ আজ্জাল শামস
আল-দিন ওমর আল বুখারি কবর জিয়ারত করতে যায়। তিনি মহানবীর (স.) ২৬তম বংশধর। তার বংশধরদের
কারণেই চীনে মুসলমানদের কিছুটা বিস্তার ঘটে।
ইউরোপ-আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোর
ইসলামিক সেন্টারেই বসে ঈদের জামাত। অনেক জায়গায় খোলা পার্কেও নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মুসলমানদের
প্রতি অমুসলিম আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিতর্ক আছে ঢের। তথাপি প্রত্যেক ঈদেই দেশটির
প্রেসিডেন্ট মুসলমান নাগরিকদের জন্য শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে থাকেন। নিউইয়র্কের মতো ব্যস্ত
শহরেও এদিন ঈদের জমায়েত ও অনুষ্ঠানের কথা বিবেচনা করে নগর কর্তৃপক্ষ পার্কিং আইন শিথিল
করে দেয়। এখানেই শেষ নয়। ঈদ উপলক্ষে ২০০১, ২০০২, ২০০৬ থেকে ২০০৯ এবং ২০১১ সালে বিশেষ
ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ!
ঈদের দিন বড় কোনো সংগঠন
কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আয়োজিত পার্টিতে অংশ নেয় আমেরিকান মুসলমানরা। এসব পার্টির
প্রাণই হলো শিশুরা। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় উপহার আর চকোলেট। একই দৃশ্য চোখে পড়বে
অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাতেও। ধর্মীয় উৎসবে সম্প্রীতির অভাব দেখা যায় না কোথাও। মুসলমানদের
ঈদ-পার্টিতে অংশ নেয় অমুসলিমরাও। এদিকে ঈদুল ফিতরের দিন সরকারি ছুটি না থাকলেও যুক্তরাজ্যের
মুসলমানদের মধ্যে উৎসবের ভাটা পড়ে না। মেয়েরা এদিন প্রতিদিনকার পোশাক বাদ দিয়ে সালোয়ার
কামিজই বেছে নেয়। পুরুষরাও স্যুট-টাই খুলে পরে নেয় শেরওয়ানি।
উৎসব পালনে বৈচিত্র্য থাকবেই।
তবে উৎসবের শেকড় কিন্তু এক। তাই দেশ আর জাতি আলাদা হলেও ঈদ উৎসবে একটা জায়গায় মিল সবার।
তা হলো, এ দিন সবার মনেই খোলা থাকে সম্প্রীতির দরজা।
লিখেছেন- ফয়সল আবদুল্লাহ
No comments:
Post a Comment