জার্মান অর্থনীতির মেরুদণ্ড
বলা হয় শহরটাকে। তাই বলে কাঠখোট্টা বাণিজ্য নিয়েই পড়ে নেই। ছুটি কাটানোর গন্তব্য হিসেবে
ভ্রমণকারীদের জন্য আরও অনেক কিছুর ডালি সাজিয়ে বসে আছে ফ্রাঙ্কফুর্ট।
জার্মানির আর্থিক স্নায়ু
ফ্রাঙ্কফুর্টের ছবি কল্পনা করতে চান? তবে চোখ বুঁজে ভাবুন বড় বড় ব্যাংক আর হোমড়া চোমড়া
ব্যবসায়ীদের ছবি। বৈশ্বিক এ শহরটি বেশি পরিচিত এর বাণিজ্যিক হুল্লোড়ের জন্য। অবশ্য
যদি আপনি ছুটির সময়টা কাটাতে চান, তবে শহরটি দেখে নয়নও জুড়োবে। আপাতদৃষ্টে নানবিধ জটিলতার
চাদরে মোড়া শহরটিকে ‘ফ্রাঙ্কফুট এম মাইন’ নামেও ডাকা হয়। আর দেশের বাইরে যারা অবকাশ কাটাতে
আগ্রহী তাদের জন্য এই শহর কিন্তু একটি যুৎসই ভূদৃশ্য মেলে ধরে আছে। গোটা দুনিয়ার সঙ্গে
বেশ পাকপাকিভাবে যুক্ত শহরটি তার অনন্য ও আধুনিক নির্মাণশৈলীর গুণে সবার নজর কেড়েছে,
আর শহরের স্বতন্ত্র অতীতের আড়ালে থেকেই উপভোগ করা যায় এর সৌন্দর্য।
অবকাশের গন্তব্য
বর্ণিল শহরটি তার অগণিত
স্থাপত্যকলার বিস্ময় নিয়ে দম্ভ করবে, এমনটাই স্বাভাবিক। অবশ্য অনেকেই মনে করে শহরটি
কিছুটা ভবিষ্যৎ ঘেঁষা এবং ছুটিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এখানে তেমন কিছু নেই। কিন্তু এটি
আসলেই একটি দারুন অভিজ্ঞতা দিতে সক্ষম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রুদেশাইম ও রাইন-এর কথা।
আপার মিডল রাইন উপত্যকার প্রবেশদ্বার এটি, যাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে
কিনা ইউনেস্কো ঘোষিত। ঊণবিংশ শতক থেকেই এ অঞ্চলটি ইউরোপীয় কবিদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে
আসছে, যা থেকে ক্রমাগত আবেগের বিচ্ছুরণ ঝরে ঝরে পড়ে।
অন্যদিকে ঢালু পাহাড়ের
সারি, প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ও ঐতিহাসিক উষ্ণ জলধারায় গোসলের জন্য বিখ্যাত হলো টনাস। এ
যেন প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের মাঝে সমস্ত কিছুর এক অদ্ভুত সন্নিবেশ। যারা তাদের প্রতিদিনকার
রুটিনমাফিক উপকরণগুলো থেকে ক্ষণিকের স্বাধীনতা খুঁজছে, তাদের জন্য উষ্ণ স্নান (থার্মাল
বাথ) হতে পারে এক আরামদায়ক অভিজ্ঞতা।
শহরের দিক নির্দেশনা অনুসরণ
করে এগোতে থাকলে, স্পষ্টতই দেখতে পাবেন শহরের এ অঞ্চলে অনেক বিস্তৃত বন-জঙ্গল আছে।
সেই সঙ্গে মাইন নদীর তীরে রয়েছে আঙুলের ক্ষেত, ঐতিহ্যবাহী কিছু স্পা টাউন, মধ্যযুগের
প্রাসাদ আর এমন কিছু রোমান্টিক গ্রাম যেখানে কাঠের তৈরি অনেক স্থাপত্যশৈলী চোখে পড়বে।
তাড়াহুড়ো করে এসব কিছু দেখা সম্ভব নয়, সময় দিতেই হবে।
এদিকটায় যা না দেখলেই নয়,
তা হলো কনিগস্টাইন প্রাসাদ। জার্মানিতে এখন যে কয়টা বড় প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে
তার মধ্যে এটা অন্যতম। এ ছাড়া ফেল্ডবার্গের পথে যেতে টনাসের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্ঘ চোখে
পড়বে। নয়নাভিরাম এ ভ্রমণপথে যাওয়ার সময় রাইন-মাইন অঞ্চলের পুরোটাই উপভোগ করতে পারবেন।
অনুসন্ধানের জন্য হাঁটুন
এখানকার লোকজনের স্বাস্থ্য
বেশ ভালো। তারা হাঁটাহাঁটিই বেশি পছন্দ করেন, তা শহরে ঘুরে বেড়াতে হোক আর অফিসে যেতে
হোক। ফ্রাঙ্কফুর্ট ঘুরে দেখতেও একই কাজ করা যায়। হেঁটে কোনো একটি শহর চষে বেড়ানোর জন্য
ফ্রাঙ্কফুর্ট রীতিমতো আদর্শ। আর হাঁটলেই আপনি এ শহরটির মাঝে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারবেন,
অনুভব করতে পারবেন এর অন্তনির্হীত যাদুমন্ত্র। এখানকার অনেক ট্রাভেল এজেন্সি থিমনির্ভর
হেঁটে বেড়ানোর আয়োজন করে থাকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট এম মাইনকে জানার জন্য যা একটি আদর্শ পন্থা।
শহরের চমৎকার সব জায়গা ঘুরে দেখতে দুই ঘণ্টাই যথেষ্ট সময়। এ সময়ে চাইলে শহরের পুরনো
টাউন সেন্টার ঘুরে আসা যায়। সারাক্ষণ কাজকর্মের গুঞ্জনে ব্যতিব্যস্ত ব্যাংকময় শহরটি
ঘুরে দেখাও বেশ মজার। ২০০ মিটার উঁচুতে মাইন টাওয়ারের ছাদে বসানো পর্যবেক্ষণ প্লাটফর্মটি
না দেখে পারা যায় না। শহরটির আপাদমস্তক মুহূর্তে আপনার চোখের সামনে এনে দেবে এটি।
হাতে যদি সময় থাকে, তবে
আপনার উচিৎ হবে ভ্রমণপথটাকে টেনে ফ্রাঙ্কফুর্টের দক্ষিণ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। জায়গার
নাম ডার্মস্টাড। কসমোপলিটন শহর বলতে যা বোঝায়, এটা তেমনই। এখানে আছে অগণিত জাদুঘর,
স্থাপত্য মিনার, পার্ক ও বাগান। এখানকার ম্যাথিলডেনহোহে শহরের শিল্পী কলোনির খ্যাতি
আছে দুনিয়াজোড়া।
স্থানীয় আস্বাদ
একটি স্থান ও এর সংস্কৃতিকে
বিচার করতে চাইলে খাবারই হলো সবচেয়ে ভালো পন্থা। আর শহরটি পরিচিত তার ‘হান্ডকাস মিট মিউজিক’, ‘গ্রিন সস’ এবং সয়েরক্রটের (বাধাকপির আচারের মতো) সঙ্গে শূকরের পাঁজরের উপরের দিককার
মাংস। এগুলোর সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্টের এক গ্লাস আপেল জুস খাওয়ার ব্যাপারে আপনাকে সবাই
পরামর্শ দেবেই। ওয়াইনটাও চেখে দেখার মতো, যা সরাসরি ‘বেমবেল’
থেকে ঢালা হয় ‘গেরিপটে’র মধ্যে । বেমবেল হলো নীলাভ ধূসর রঙা একটি মাটির পাত্র আর গেরিপতে হলো
একটি বিশেষায়িত কাচের গ্লাস যাতে প্রথাগতভাবে আপেলের রস পান করা হয়। মজার বিষয় হলো
গত ২৫০ বছর ধরেই এই আপেল-ওয়াইনটি স্থানীয়দের কাছে সেরা পানীয় হিসেবে টিকে আছে। সাইডারের
(আপেল থেকে তৈরি এক ধরনের মদ) মতো স্বাদযুক্ত এই পানীয়টি এক-দুই গ্লাস পান করার সবচেয়ে
ভালো জায়গাটি হলো ফ্রাঙ্কফুর্টের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উপশহর সাকসেনহাউসেন।
আর এর বাইরে যারা চিবুতে
খুব পছন্দ করেন, তাদের জন্য উপযুক্ত জায়গা হলো ‘ফ্রেসগাস’। এটাকে বলা যায় ফ্রাঙ্কফুর্টের রান্নার রাস্তা,
যেখানে খুঁজে পাবেন অগণিত ক্যাফে, লাঞ্চরুম ও স্ন্যাক বার। এখানে একটি মাত্র সড়কের
দুপাশেই পাওয়া যাবে অসংখ্য ঘরানার রেস্তরাঁ।
ইচ্ছেপূরণের কেনাকাটা
চোখে দেখা যায় কিংবা ছোঁয়া
যায়, এমন কিছু স্মৃতিময় উপকরণ সঙ্গে না নিয়ে একটি শহর ত্যাগ করা রীতিমতো মহা অন্যায়।
মূলধারার কেনাকাটার তোরণগুলো সবসময়ই স্বাগত জানাবে, আর ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যাম মাইন মেলে
ধরবে তার বৈচিত্র্যে ভরা ডালি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ফ্রাঙ্কফুর্টের ডাউনটাউনের দিকে
বাঁকানো আয়নায় মোড়ানো জিল নামের অতিকায় এলাকাটির কথা, যা কিনা কেনাকাটায় জার্মানির
সবচেয়ে লাভজনক অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। পুরো উপশহরটি ট্রামে চড়ে ঘোরা যাবে। দেখা যাবে
বেশ কিছু চমৎকার মল ও শপিং সেন্টার। অথবা মূল শহর থেকে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে
পারেন ওয়েরথাইম ভিলেজে। কেনাকাটার গ্রাম হিসেবে খ্যাত এ শহরে মিলবে অনন্য এক জায়গা।
বিলাসি কেনাকাটার জন্য
আছে গোথেসট্রাসে। এখানকার নামিদামি দোকানগুলোতে পাওয়া যাবে ডিজাইনার বুটিক ও চটকদার
ডিপার্টমেন্ট স্টোর। পাশেই আছে ফ্রেসগাস। তাই দুটো একসঙ্গে ঘুরতে পারলে ভালো। এগুলো
ছাড়াও আলাদা আলাদা চাহিদা মেটানোর জন্য সাকসেনহাউসেন ও বোর্নহাইমের বার্গারস্ট্রাসির
দোকানপাটে ঢুঁ মারতে পারেন। স্যুভেনিয়র-এর জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টের রোমারবার্গে যেতে পারেন।
ঐতিহ্যবাহী ও পুরনো টাউন হলটা সেখানেই। এখানে মিলবে অনেকগুলো বিশেষ ধরনের দোকান। দৃষ্টিনন্দন
এই প্লাজাটির চারপাশে দেখতে পাবেন আধা কাঠের তৈরি প্রায় শতবর্ষী পুরনো বাড়ি।
No comments:
Post a Comment